নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ কুরআন ও হাদীসের আলোকে আত্মসংগ্রাম

চতুর্থ পর্ব-নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ কুরআন ও হাদীসের আলোকে আত্মসংগ্রাম

চতুর্থ পর্ব-

২। ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ (স্ব-অভিযোগকারী আত্মা) 

নাফস্ এর দ্বিতীয় স্তরটিকে ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ বলা হয়, অর্থাৎ স্ব-অভিযোগকারী আত্মা। এই স্তরটি আধ্যাত্মিক সচেতনতার একটি উচ্চতর স্তরকে প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে ব্যক্তি পাপ করার বা তাদের নিম্নমানের আকাঙ্ক্ষার অনুসরণ করার পর অপরাধবোধ এবং অনুশোচনা অনুভব করতে শুরু করে। এই স্তরে, বিশ্বাসী সম্পূর্ণরূপে ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়, কিন্তু তারা তাদের কাজের প্রতি বেশি সচেতন এবং তাদের ভুল সম্পর্কে চিন্তা করার সক্ষমতা অর্জন করে।

আল্লাহ এই স্তরটির উল্লেখ করেছেন কুরআনেঃ

وَ لَاۤ اُقۡسِمُ بِالنَّفۡسِ اللَّوَّامَۃِ ؕ﴿۲﴾

“আর আমি স্ব-অভিযোগকারী আত্মার উপর কসম খাচ্ছি।”

(সূরা আল-কিয়ামাহ, ৭৫ঃ২)

‘‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’’ স্ব-সচেতনতা এবং বাড়তে থাকা দায়িত্ববোধ দ্বারা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তি বুঝতে পারে যখন তারা ভুল কাজ করেছে এবং আল্লাহর কাছে তওবা করতে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য বোধ করে। নিম্নমানের আকাঙ্ক্ষা এবং বিবেকের মধ্যে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব একটি অভ্যন্তরীণ চাপের সৃষ্টি করে, কিন্তু এটি আত্ম-পবিত্রকরণের পথে একটি অপরিহার্য অংশ।

– ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’র বৈশিষ্ট্যঃ 

– পাপ এবং ভুলের প্রতি সচেতনতা

– অপরাধবোধ এবং অনুশোচনা অনুভব

– ক্ষমা এবং সংস্কারের ইচ্ছা

– সঠিক এবং ভুলের মধ্যে দোলন

এই স্তরটি জিহাদ আল-নাফস্ এ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। বিশ্বাসী তাদের কাজের প্রতি আরও সচেতন হয়ে ওঠে এবং তাদের নিম্নমানের আকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে উঠতে সাহায্য করতে পারে এমন ভালো অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করে। ধারাবাহিক তওবা (‘তওবা’) এবং আত্মশৃঙ্খলার মাধ্যমে, এই স্তরের একজন ব্যক্তি ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিক পরিশোধনের পরবর্তী স্তরের দিকে অগ্রসর হতে পারে।

৩. নাফস্ আল-মুতমইন্না (প্রশান্ত আত্মা) 

নাফস্ এর সর্বোচ্চ এবং সবচেয়ে পরিশীলিত স্তরটিকে ‘নাফস্ আল মুতমাইন্নাহ’ বলা হয়, অর্থাৎ প্রশান্ত আত্মা। এই স্তরে, ব্যক্তি একটি গভীর আধ্যাত্মিক প্রশান্তি অর্জন করেছে, তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সমন্বয় করেছে। ‘নাফস্ আল মুতমাইন্নাহ’ আল্লাহর নির্দেশে সন্তুষ্ট এবং ইবাদত, আনুগত্য, এবং তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণে শান্তি খুঁজে পায়।

আল্লাহ এই আত্মাকে কুরআনে বর্ণনা করেছেনঃ

یٰۤاَیَّتُهَا النَّفۡسُ الۡمُطۡمَئِنَّۃُ ﴿٭ۖ۲۷﴾

ارۡجِعِیۡۤ اِلٰی رَبِّكِ رَاضِیَۃً مَّرۡضِیَّۃً ﴿ۚ۲۸﴾

فَادۡخُلِیۡ فِیۡ عِبٰدِیۡ ﴿ۙ۲۹﴾

وَ ادۡخُلِیۡ جَنَّتِیۡ ﴿۳۰﴾

“হে প্রশান্ত আত্মা, তোমার প্রভুর কাছে ফিরে যাও, সন্তুষ্ট এবং সন্তোষজনক [তাঁর কাছে]। আমার দাসদের মধ্যে প্রবেশ কর এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।”

(সূরা আল-ফজর, ৮৯ঃ২৭-৩০)

এই স্তরে, বিশ্বাসী নাফস্ এর বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ সংগ্রামে দক্ষ হয়ে ওঠে এবং প্রশান্তি ও পূর্ণতার অবস্থায় বাস করে। হৃদয় ঈর্ষা, অহংকার, এবং অন্যান্য ধ্বংসাত্মক আবেগ মুক্ত থাকে, এবং ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকে। এই অবস্থা জিহাদ আল-নাফস্ এর চূড়ান্ত লক্ষ্য, কারণ এটি বিশ্বাসীকে আল্লাহর নিকটে নিয়ে আসে এবং এই জীবন ও পরকালে সফলতার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

নাফস্ আল মুতমাইন্নাহ বৈশিষ্ট্যঃ

– আল্লাহর ইচ্ছায় অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং সন্তুষ্টি

– মৌলিক আকাঙ্ক্ষা এবং অহংকার থেকে মুক্তি

– আল্লাহর প্রতি সর্বদা সচেতনতা (‘তাকওয়া’)

– ইবাদত এবং আনুগত্যে সন্তুষ্টি

‘নাফস্ আল মুতমাইন্নাহ’র স্তরে পৌঁছানো একটি দীর্ঘ, নিবেদিত আধ্যাত্মিক পবিত্রকরণের প্রক্রিয়ার ফল। এটি ধারাবাহিক আত্মশৃঙ্খলা, চিন্তাভাবনা, এবং আল্লাহর প্রতি নিবেদন প্রয়োজন। যারা এই স্তরের আধ্যাত্মিক উন্নতি অর্জন করে, তাদের জান্নাতে চিরস্থায়ী শান্তি এবং চিরকালীন পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

৪। নাফসের স্তরগুলির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া 

নাফস্ এর স্তরগুলির মধ্যে যাত্রা সরলরেখার মতো নয়, এবং ব্যক্তি তাদের পরিস্থিতি এবং আধ্যাত্মিক সচেতনতার স্তরের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে পরিবর্তনশীল হতে পারে। যখন ‘‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’’ পার্থিব আকাঙ্ক্ষায় মগ্ন একটি আত্মাকে প্রতিনিধিত্ব করে, তখন ‘‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’’ আত্ম-মানসিকতা এবং অপরাধবোধের সূচনা করে, যা সংস্কারের ইচ্ছা সৃষ্টি করে। অবশেষে, ‘‘নাফস্ আল মুতমাইন্নাহ’’ এমন একটি আত্মাকে চিহ্নিত করে যা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শান্তি পেয়েছে।

এই স্তরের মধ্যে অগ্রসর হওয়ার জন্য ধারাবাহিক প্রচেষ্টা, অন্তর্দৃষ্টি, এবং একজনের চরিত্রকে পরিশীলিত করার প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। প্রতিদিন জিহাদ আল-নাফস্ এ নিযুক্ত হওয়া—অথবা ইবাদত, জ্ঞান অনুসন্ধান, বা আত্ম-নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে—একজন বিশ্বাসীকে নাফস্ এর স্তরগুলির মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে উন্নতি করতে এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ অর্জন করতে সক্ষম করে।

৫। নাফস্ পরিশীলনের উপায় 

ইসলাম কিছু উপায় এবং প্রথা প্রদান করে যা বিশ্বাসীদের আধ্যাত্মিক পবিত্রকরণের যাত্রায় সহায়তা করে এবং নাফস্ এর পরিশীলনে সাহায্য করে। এর মধ্যে কিছু প্রথা অন্তর্ভুক্তঃ

– সালাহ (নামাজ): 

নিয়মিত নামাজ বিশ্বাসীকে আল্লাহর সাথে যুক্ত করে এবং তাদের উদ্দেশ্যের স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি নাফস্ কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে এবং আল্লাহর আদেশে আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের গুরুত্বকে পুনর্ব্যক্ত করে।

– রোজা (সাওম): 

রোজা নাফস্ কে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার একটি শক্তিশালী উপায়। খাবার, পানীয় এবং অন্যান্য শারীরিক আনন্দ থেকে বিরত থেকে, একজন ব্যক্তি তাদের আত্মাকে আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করতে প্রশিক্ষিত করে।

– দানে (যাকাত এবং সদাকাহ): 

অন্যদের প্রতি দান করার মাধ্যমে হৃদয়কে লোভ এবং স্বার্থপরতা থেকে পরিষ্কার করা যায়। দানদানিত্ব উৎপন্ন করে এবং বিশ্বাসীদের মনে করিয়ে দেয় যে সম্পদ এবং ভৌত সম্পদ অস্থায়ী।

– জিকির (আল্লাহর স্মরণ):

নিয়মিত আল্লাহর স্মরণ ‘জিকির’ এর মাধ্যমে হৃদয়কে তাঁর উপর কেন্দ্রীভূত রাখে এবং নাফস্ কে পার্থিব বিভ্রান্তিতে গৃহীত হতে রোধ করে।

– তাওবা (অনুতাপ): 

পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা নাফস্ এর পরিশীলনের একটি অপরিহার্য অংশ। এটি আত্মাকে বিনম্র করে এবং স্মরণ করিয়ে দেয় যে আল্লাহর রহমত সর্বদা তাদের জন্য প্রাপ্য যারা আন্তরিকভাবে তাঁর দিকে ফিরে আসে।

নাফস্ এর স্তরগুলি বোঝা বিশ্বাসীদের জন্য একটি রূপরেখা প্রদান করে যখন তারা আধ্যাত্মিক পবিত্রকরণের চলমান প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত থাকে। আদেশদাতার আত্মা (‘‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’’) থেকে প্রশান্ত আত্মা (‘নাফস্ আল মুতমাইন্নাহ’) পর্যন্ত, প্রতিটি স্তর একটি ভিন্ন স্তরের উপর আত্মাকাঙ্ক্ষার নিয়ন্ত্রণ এবং আল্লাহর সাথে একটি গভীর সংযোগ প্রতিফলিত করে। নামাজ, রোজা, দান, এবং অনুতাপের মাধ্যমে, একজন ব্যক্তি নাফস্ এর নিম্নস্তরের প্রবৃত্তির বাইরে যেতে এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি ও সন্তুষ্টির একটি অবস্থায় পৌঁছাতে পারে।

পরবর্তী অধ্যায়ে, আমরা আলোচনা করব কীভাবে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর সাহাবাগণ নিজেদের জীবনে জিহাদ আল-নাফস্ এর নীতিগুলি বাস্তবায়ন করেছিলেন, যা সকল বিশ্বাসীর জন্য চিরকালীন পাঠ প্রদান করে।

অধ্যায় ৬। নবীর সাহাবা এবং তাদের জিহাদ আল-নাফস্

নবী মুহাম্মদ (সা.) এর সাহাবাগণ, যাদেরকে সাহাবাহ বলা হয়, তারা জিহাদ আল-নাফস্ এ নিযুক্ত হওয়ার এবং তাদের আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সেরা উদাহরণ। তাদের অবিচল নিষ্ঠা, ত্যাগ, এবং নবীর (সা.) এবং ইসলামের প্রতি নিবেদন আত্মশৃঙ্খলা, বিনম্রতা, এবং আধ্যাত্মিক সংগ্রামের জন্য চিরকালীন পাঠ দেয়। তাদের কাহিনীগুলির মাধ্যমে, আমরা নাফস্ কে জয় করার এবং ন্যায়ের পথে জীবনযাপন করার ধারণা লাভ করি।

এই অধ্যায়ে, আমরা কিছু উল্লেখযোগ্য সাহাবার জীবন ও আল্লাহর পথে আত্মা পবিত্রকরণের প্রতি তাদের অসাধারণ নিবেদন নিয়ে আলোচনা করব।

১। আবু বকর আস-সিদ্দীক (রাঃ): বিনম্রতা ও দানের শিখর 

আবু বকর আস-সিদ্দীক (রাঃ), প্রথম খলিফা এবং নবী মুহাম্মদ (সা.) এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সাহাবা, বিনম্রতা, দানশীলতা, এবং বিশ্বাসের মধ্যে দৃঢ়তার মাধ্যমে জিহাদ আল-নাফস্ এর একটি আদর্শ মডেল। তাঁর কোমল চরিত্র এবং অন্যদের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধের জন্য পরিচিত, আবু বকর (রাঃ) আত্মত্যাগী সেবার মাধ্যমে নাফস্ নিয়ন্ত্রণের শিল্প প্রদর্শন করেছেন এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল নিবেদন রেখেছেন।

আবু বকরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুণগুলির মধ্যে একটি ছিল তাঁর দানশীলতা। একজন ধনী ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও, তিনি তাঁর সম্পদকে সম্পূর্ণরূপে ইসলামের সেবায় ব্যবহার করতেন। তিনি নবী (সা.) এবং তাঁর মিশনের সমর্থনে প্রায় সবকিছু দান করেছিলেন। তাবুকের যুদ্ধে, যখন নবী (সা.) মুসলিম সেনাবাহিনীর জন্য সাহায্যের আহ্বান করেছিলেন, আবু বকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নবীর কাছে নিয়ে এসেছিলেন। যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি তাঁর পরিবারের জন্য কী রেখেছেন, আবু বকর (রাঃ) সহজভাবে উত্তর দিয়েছিলেনঃ

“আমি তাদের জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রসূলকে রেখে এসেছি।”

(সুনান আবি দাউদ)

এই শক্তিশালী বিবৃতি আবু বকরের আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং পরকালের স্বার্থে পার্থিব সুখ স্বীকার করার প্রস্তুতি প্রতিফলিত করে। তাঁর সক্ষমতা ভৌত সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আধ্যাত্মিক যাত্রায় মনোনিবেশ করার ছিল নাফস্ এর আধিপত্য এবং ক্ষমতা, স্বীকৃতি, বা সম্পদের জন্য আকাঙ্ক্ষার বাইরে ওঠার ফল।

আরো গুরুত্বপূর্ণ, আবু বকর (রাঃ) তাঁর জীবনের প্রতিটি দিকেই বিনম্রতা প্রদর্শন করেছেন। নবীর মৃত্যুর পর মুসলিম উম্মাহর নেতা হিসেবে তাঁর অবস্থান থাকা সত্ত্বেও, তিনি বিনম্র ছিলেন, সবসময় অন্যদের থেকে পরামর্শ নিতেন এবং তাঁর সাফল্য আল্লাহর প্রতি দায়ী করতেন। অহংকারের একটি বড় ফাঁদ, যা নাফস্ এর একটি প্রধান ট্যাপ, থেকে পড়ে যাওয়ার প্রতি তাঁর বিনম্রতা এবং ভয় সকল বিশ্বাসীদের জন্য একটি উচ্চ মান স্থাপন করেছে।

২. উমর ইবন আল-খাত্তাব (রা): শৃঙ্খলার মাধ্যমে নফসের পরিবর্তন

উমর ইবন আল-খাত্তাব (রা), ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, তাঁর শক্তিশালী চরিত্র, ন্যায়বিচার এবং কঠোর শৃঙ্খলার জন্য স্মরণীয়। তাঁর রাগী স্বভাব থেকে একজন ন্যায়পরায়ণ, আত্মসংযমী এবং পরহেজগার নেতায় রূপান্তরের ঘটনা জিহাদ আল-নফস বা নফসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তিকে প্রতিফলিত করে।

ইসলাম গ্রহণের আগে, উমর (রা) শক্তিশালী একজন মানুষ ছিলেন, কিন্তু তার এই শক্তি প্রায়শই রাগ এবং কঠোরতার মধ্যে প্রকাশ পেত। তবে ইসলাম গ্রহণের পর তিনি এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে শিখেছিলেন। উমর (রা) তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তার বিচারগুলোতে দয়া ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করতে পরিচিত হন। এই পরিবর্তন তার গভীর আত্মপর্যালোচনা এবং নিজের নফসের চাহিদা নিয়ন্ত্রণের জন্য তার নিরন্তর প্রচেষ্টার ফল।

উমর (রা) তার নেতৃত্বের দায়িত্বের প্রতিও অত্যন্ত মনোযোগী ছিলেন। আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার ভয় তাকে সর্বদা ন্যায়পরায়ণ ও সততার সাথে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি রাতের বেলায় মদিনার রাস্তায় হাঁটতেন, যাতে তিনি নিশ্চিত করতে পারেন যে তার প্রজাদের প্রয়োজন মেটানো হয়েছে এবং কেউই তাঁর শাসনের অধীনে কষ্ট পাচ্ছে না। উমর (রা) এই বিশ্বাস পোষণ করতেন যে, তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা তার নফসের প্রভাবের কারণে হতে পারে, যা তার নৈতিকতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তার বিখ্যাত উক্তিটি এই দায়িত্ববোধকে প্রকাশ করেঃ

“যদি ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুরও ক্ষুধায় মারা যায়, তবে আমি ভয় করি আল্লাহ আমাকে তার জন্য জিজ্ঞাসা করবেন।”

এই উক্তি উমরের গভীর সচেতনতা প্রকাশ করে যে, নফস মানুষের মধ্যে অবহেলা, অহংকার বা সহানুভূতির অভাব সৃষ্টি করতে পারে। তার আত্মাকে ক্রমাগত পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে, উমর (রা) আজও ন্যায় ও নেতৃত্বের একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হন।

৩. উসমান ইবন আফফান (রা): সম্পদের লোভের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

উসমান ইবন আফফান (রা), ইসলামের তৃতীয় খলিফা, ছিলেন ধনী এবং প্রভাবশালী একজন মানুষ। তবুও সম্পদের প্রলোভন এবং বিলাসিতার আকর্ষণ থেকে নিজেকে বিরত রাখার মাধ্যমে তিনি তার নফসের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে পেরেছিলেন, তা প্রমাণিত হয়। উসমান (রা) তার বিনয়, লজ্জাশীলতা এবং বিশাল দানশীলতার জন্য পরিচিত ছিলেন, যদিও তার প্রচুর সম্পদ ছিল।

উসমান (রা) নিয়মিত তার ধন ইসলামের সেবায় ব্যয় করতেন। তার সবচেয়ে স্মরণীয় উদাহরণগুলোর একটি হল মসজিদে নববীর সম্প্রসারণের জন্য তহবিল প্রদান এবং তাবুক যুদ্ধে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করা। তার এই উদারতা দেখায় যে, তার হৃদয় সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট ছিল না, বরং তিনি ইসলামের জন্য ব্যয় করতে সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন।

তিনি সাধারণত সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন, সাধারণ পোশাক পরতেন এবং সহজ খাবার খেতেন, যদিও তার বিলাসী জীবনযাপন করার যথেষ্ট উপায় ছিল। তার বিনয় তার নেতৃত্বের মধ্যেও প্রতিফলিত হত, যেখানে তিনি ব্যক্তিগত লাভের পরিবর্তে জনগণের সেবা করার উপর জোর দিতেন।

উসমানের (রা) সম্পদের প্রলোভনের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম আমাদের জন্য *জিহাদ আল-নফস*-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। প্রচুর সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, নফসের চাহিদার বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষকে সতর্ক থাকতে হয়। উসমানের (রা) জীবন আমাদের শেখায় যে, প্রকৃত সম্পদ অন্তরের মধ্যে বিদ্যমান এবং নফসকে পরাজিত করার মানে হল কম দিয়ে তুষ্ট থাকা এবং অধিক দিয়ে উদার হওয়া।

৪. আলি ইবন আবি তালিব (রা): জ্ঞান ও কর্মের ভারসাম্য

আলি ইবন আবি তালিব (রা), নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর চাচাত ভাই এবং জামাতা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির প্রতিমূর্তি হিসেবে বিবেচিত। ইসলামের প্রতি তার গভীর বোঝাপড়া এবং প্রতিদিনের জীবনে সেই জ্ঞান প্রয়োগ করার ক্ষমতা তার নফসের উপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ দেয়।

আলি (রা) তার বাগ্মিতা ও জ্ঞানী বক্তব্যের জন্য পরিচিত ছিলেন, যেগুলোর অনেকগুলোতেই তিনি নফস নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তার বিখ্যাত উক্তিগুলোর একটি হলঃ

“তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে তোমার নফস, যা তোমার দেহের মধ্যে রয়েছে।”

এই উক্তি আমাদের শেখায় যে, আধ্যাত্মিক সাফল্য অর্জনের জন্য প্রতিটি বিশ্বাসীকে নিজের নফসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আলি (রা) তার অনুসারীদের সবসময় স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, জ্ঞান একা যথেষ্ট নয়; এটি অবশ্যই কর্মের সাথে মিলিত হতে হবে। তিনি জোর দিতেন যে, প্রকৃত জ্ঞান হচ্ছে সেই জ্ঞান যা আত্মাকে পরিবর্তন করে এবং সঠিক কাজের দিকে পরিচালিত করে।

তার জীবনজুড়ে, আলি (রা) অসীম সাহস এবং ধৈর্য প্রদর্শন করেছেন, বিশেষ করে কঠিন পরিস্থিতিতে। তিনি যখন অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এবং বিদ্রোহের মুখোমুখি হন, তখনও তিনি ধৈর্য এবং ন্যায়বিচারের পথেই ছিলেন, কখনোই ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য তার নৈতিকতা ত্যাগ করেননি। জ্ঞান ও কর্মের ভারসাম্য বজায় রেখে এবং নফসকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, আলি (রা) দেখিয়েছেন কিভাবে আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা ও সততার সাথে জীবনযাপন করা যায়।

৫. সাহাবীদের নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের উত্তরাধিকার

সাহাবীদের জীবন জিহাদ আল-নফস-এর অসাধারণ শিক্ষা দিয়ে পূর্ণ। তাদের সংগ্রাম কেবল বাহ্যিক শত্রুদের সঙ্গে ছিল না; তাদের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামগুলো ছিল ততটাই কঠিন, যদি আরও না হয়। আবু বকর (রা)-এর বিনয় এবং দানশীলতা, উমর (রা)-এর আত্মসংযম ও ন্যায়বিচার, উসমান (রা)-এর সম্পদের প্রতি অনাসক্তি এবং আলি (রা)-এর প্রজ্ঞা ও ধৈর্য, প্রত্যেকেই দেখিয়েছেন যে, নফসকে আয়ত্ত করা একটি আজীবন চলমান প্রচেষ্টা, যা ধৈর্য, নিষ্ঠা এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে।

সাহাবীদের উদাহরণকে এত শক্তিশালী করে তোলে যে, তারা ইসলামের শিক্ষাকে বাস্তবে প্রয়োগ করেছেন। তারা কেবল নবী মুহাম্মাদ (সা) থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেননি, বরং তার উদাহরণ অনুসারে জীবনে তা বাস্তবায়ন করেছেন। তারা দেখিয়েছেন কিভাবে জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হয় এবং নফসকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে একটি সঠিক ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনযাপন করতে হয়।

তাদের উত্তরাধিকার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জিহাদ আল-নফস-এর পথ সহজ নয়, তবে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের উদাহরণ অনুসরণ করে, আজকের বিশ্বাসীরা তাদের আত্মাকে শুদ্ধ করার, প্রলোভনকে প্রতিহত করার এবং সঠিক ও সততার সঙ্গে জীবনযাপন করার পাঠ শিখতে পারে।

৬ষ্ঠ অধ্যায়ের উপসংহার

নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর সাহাবীরা জিহাদ আল-নফস-এর ক্ষেত্রে সেরা উদাহরণ স্থাপন করেছেন। তাদের জীবন থেকে বোঝা যায় যে, আত্মার বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম একটি নিরন্তর প্রচেষ্টা দাবি করে, তবে এটি এমন একটি প্রচেষ্টা যা দুনিয়া ও আখিরাতে বিশাল পুরস্কার নিয়ে আসে। আবু বকর (রা)-এর বিনয় থেকে উমর (রা)-এর শৃঙ্খলা, উসমান (রা)-এর উদারতা এবং আলি (রা)-এর প্রজ্ঞা—প্রত্যেক সাহাবী নফসের বিভিন্ন দিক আয়ত্ত করেছিলেন এবং মুসলিমদের জন্য অমর শিক্ষা রেখে গেছেন।

পরবর্তী অধ্যায়ে, আমরা আত্মশুদ্ধির সেই উপকরণগুলো নিয়ে আলোচনা করব যা ইসলামি আধ্যাত্মিকতা বিশ্বাসীদের তাদের নিজস্ব জিহাদ আল-নফস-এ নিযুক্ত করতে সাহায্য করার জন্য প্রদান করে।

অধ্যায় ৭: ইসলামি আধ্যাত্মিকতায় আত্মশুদ্ধির উপকরণ

ইসলাম এমন একটি পরিপূর্ণ উপকরণ ও চর্চার প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে যা বিশ্বাসীদের তাদের আত্মাকে শুদ্ধ করতে এবং নফসের ভিত্তিহীন চাহিদাগুলো অতিক্রম করতে সাহায্য করে। এই উপকরণগুলো কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার উপর ভিত্তি করে গঠিত এবং মুসলিমদের *জিহাদ আল-নফস*-এ সঠিকভাবে নিযুক্ত থাকার জন্য আধ্যাত্মিক একটি টুলকিট হিসাবে কাজ করে। নামাজ, রোজা, আল্লাহর স্মরণ এবং তওবা থেকে শুরু করে, এই চর্চাগুলো আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার, আত্মাকে শৃঙ্খলিত করার এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

এই অধ্যায়ে, আমরা ইসলামি আধ্যাত্মিকতার মধ্যে আত্মশুদ্ধির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ নিয়ে আলোচনা করব এবং দৈনন্দিন জীবনে নফসের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামে সেগুলো কীভাবে প্রয়োগ করা যায় তা বিশ্লেষণ করব।

১. সালাহ (নামাজ): আল্লাহর স্থায়ী স্মরণ 

সালাহ বা নামাজ ইসলামি উপাসনার কেন্দ্রবিন্দু এবং আত্মশুদ্ধির অন্যতম শক্তিশালী উপকরণ। দিনে পাঁচবার নামাজ আদায় করা আল্লাহর উপস্থিতির একটি নিরন্তর স্মারক এবং বিশ্বাসী ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যে সম্পর্ককে মজবুত করে। নামাজের মাধ্যমে মুসলিমরা আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি আত্মসমর্পণ করে, তাদের নিয়তগুলোকে সঠিক পথে স্থাপন করে এবং নফসের প্রলোভন থেকে সুরক্ষা চায়।

নবী মুহাম্মাদ (সা) নামাজের পরিবর্তনশীল শক্তি সম্পর্কে জোর দিয়েছেনঃ

اِنَّ الصَّلٰوۃَ تَنۡهٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡكَرِ ؕ

“নিশ্চয়ই, সালাহ অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।”

(সূরা আল-আনকাবুত, ২৯:৪৫)

নামাজ একজন মুসলিমের দিনের রুটিন তৈরি করে, যা চিন্তা ও আত্মপলব্ধির মুহূর্ত তৈরি করে। এটি আল্লাহর প্রতি সচেতনতা (তাকওয়া) তৈরি করতে সাহায্য করে, যা নফসের প্রভাব থেকে একটি ঢাল হিসেবে কাজ করে। নামাজের সময়, বিশ্বাসীরা তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য—আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা—এই বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, যা তাদের দুনিয়াবি বিভ্রান্তি ও নফসের চাহিদা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে সাহায্য করে।

– প্রায়োগিক প্রয়োগঃ

– নামাজের সময় মনোযোগী এবং সচেতন থাকুন, পাঠ করা আয়াতগুলোর অর্থের প্রতি মনোনিবেশ করুন।

– সিজদার মুহূর্তগুলোতে আন্তরিকভাবে দোয়া করুন, আল্লাহর নিকট নফস নিয়ন্ত্রণের শক্তি চান।

– আল্লাহকে সারাদিন স্মরণ করে নামাজের বাইরে সচেতনতা অনুশীলনকে সম্প্রসারিত করুন।

২. সাওম (রোজা): আত্মার শৃঙ্খলা 

বিশেষ করে রমজান মাসে রোজা রাখা আত্মসংযম এবং শৃঙ্খলার একটি শক্তিশালী অনুশীলন। ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য, পানীয় এবং অন্যান্য শারীরিক তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে, বিশ্বাসীরা তাদের ইচ্ছাকে দমন করতে এবং আধ্যাত্মিক বিকাশের দিকে মনোযোগ দিতে প্রশিক্ষিত হয়। রোজা রাখা মুসলিমদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তারা তাদের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম এবং আধ্যাত্মিক লক্ষ্যগুলোর অনুসরণ দুনিয়াবি তৃপ্তির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কুরআন রোজার আধ্যাত্মিক উপকারিতা তুলে ধরেঃ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا كُتِبَ عَلَیۡكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿۱۸۳﴾ۙ

“হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনটি তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।”

(সূরা আল-বাকারাহ, ২:১৮৩)

রোজা ধৈর্য, সহনশীলতা এবং কম ভাগ্যবানদের প্রতি সহানুভূতির শিক্ষা দেয়। এটি বিশ্বাসীকে তাদের আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা সম্পর্কে চিন্তা করতে বাধ্য করে এবং তাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সমস্ত দুনিয়াবি তৃপ্তি সাময়িক। এই আত্মত্যাগের মাধ্যমে, নফস দুর্বল হয়ে যায় এবং আত্মা শক্তিশালী হয়, যা ব্যক্তিকে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যায়।

– প্রায়োগিক প্রয়োগঃ

– রমজানের বাইরে ঐচ্ছিক রোজাগুলো অন্তর্ভুক্ত করুন, যেমন সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা, যা নবী মুহাম্মাদ (সা) নিয়মিত পালন করতেন।

– শুধু খাদ্য থেকে বিরত থাকা নয়, বরং নেতিবাচক চিন্তা, কথা এবং কাজ থেকেও বিরত থাকার চেষ্টা করুন যা অন্যদের ক্ষতি করতে পারে বা আধ্যাত্মিক অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

– রমজান মাসকে গভীর আত্মপলব্ধি, আত্মশুদ্ধি এবং স্থায়ী আচরণগত পরিবর্তনের জন্য একটি সময় হিসেবে ব্যবহার করুন।

৩. জিকর (আল্লাহর স্মরণ): আধ্যাত্মিক সচেতনতার চাবিকাঠি 

জিকর বা আল্লাহর স্মরণ ইসলামি আধ্যাত্মিকতার একটি কেন্দ্রীয় অনুশীলন। এর মাধ্যমে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী পুনরাবৃত্তি করা, কুরআনের আয়াত পাঠ করা এবং প্রশংসা ও প্রার্থনার দোয়া করা হয়। জিকরের মাধ্যমে একজন মুসলিম তার জীবনে আল্লাহর উপস্থিতির প্রতি আরও সচেতন হয়ে ওঠে, যা নফসের প্রভাব প্রতিহত করতে সাহায্য করে।

আল্লাহ কুরআনে তাঁর নিরন্তর স্মরণে উৎসাহিত করেছেনঃ

فَاذۡكُرُوۡنِیۡۤ اَذۡكُرۡكُمۡ وَ اشۡكُرُوۡا لِیۡ وَ لَا تَكۡفُرُوۡنِ ﴿۱۵۲﴾

“তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর কৃতঘ্ন হয়ো না।”

(সূরা আল-বাকারাহ, ২:১৫২)

জিকর বা আল্লাহর স্মরণ হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে, নেতিবাচক আবেগগুলোকে দূর করে এবং আধ্যাত্মিক লক্ষ্যের দিকে মনোযোগ ধরে রাখে। যত বেশি একজন ব্যক্তি জিকরে লিপ্ত হয়, তত কম সে নফসের প্রভাবে বা দুনিয়ার ধোঁকায় বিভ্রান্ত হয়। এটি আভ্যন্তরীণ শান্তি, তৃপ্তি এবং কৃতজ্ঞতা বৃদ্ধি করে এবং বিশ্বাসী ও আল্লাহর মধ্যে সরাসরি সংযোগ সৃষ্টি করে।

– প্রায়োগিক প্রয়োগঃ

– প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে জিকর করার অভ্যাস গড়ে তুলুন, বিশেষত সকালে এবং সন্ধ্যায়, নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর উদাহরণ অনুসারে।

– সারাদিন সুবহানাল্লাহ (আল্লাহর মহিমা), আলহামদুলিল্লাহ (আল্লাহর প্রশংসা) এবং আল্লাহু আকবার (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ) এর মতো সরল বাক্য পাঠ করুন, যা আধ্যাত্মিক সচেতনতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

– আল্লাহর নাম ও গুণাবলী পাঠ করার সময় এগুলোর অর্থ নিয়ে চিন্তা করুন এবং আপনার চরিত্র ও কর্মকাণ্ডকে সেগুলো দ্বারা প্রভাবিত হতে দিন।

৪. তওবা (অনুশোচনা): শুদ্ধির পথ 

তওবা বা অনুশোচনা জিহাদ আল-নফস-এর একটি অপরিহার্য দিক। মানুষ হিসেবে আমরা সকলেই ভুল করি এবং পাপে লিপ্ত হই, তবে ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, যারা সঠিক পথে ফিরে আসতে চায় তাদের জন্য আন্তরিক অনুশোচনার দ্বার সবসময় খোলা থাকে। তওবা শুধুমাত্র অতীতের পাপের জন্য ক্ষমা চাওয়া নয়, বরং ভবিষ্যতে ওই কাজগুলো পুনরায় না করার দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশও করে।

কুরআনে বারবার আল্লাহর দয়া এবং ক্ষমাশীলতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছেঃ

اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ التَّوَّابِیۡنَ وَ یُحِبُّ الۡمُتَطَهِّرِیۡنَ ﴿۲۲۲﴾

“নিশ্চয়ই, আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন যারা নিয়মিত তওবা করে এবং যারা নিজেদের শুদ্ধ করে।”

(সূরা আল-বাকারাহ, ২:২২২)

তওবায় লিপ্ত হওয়া বিশ্বাসীকে তার দুর্বলতা স্বীকার করতে, নিজের কর্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তা করতে এবং ধারাবাহিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করতে সাহায্য করে। এটি নফসকে নম্র করে, তাকে তার আল্লাহর দয়া ও পথনির্দেশনার উপর নির্ভরশীলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিয়মিত তওবায় আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে, একজন ব্যক্তি আধ্যাত্মিক পবিত্রতা বজায় রাখতে এবং অহংকার বা আত্মগর্বের ফাঁদ থেকে বাঁচতে পারে।

– প্রায়োগিক প্রয়োগঃ

– নিয়মিতভাবে আত্মসমীক্ষায় (মুহাসাবাহ) লিপ্ত হন, প্রতিদিনের শেষে আপনার কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করুন এবং করা পাপের জন্য ক্ষমা চান।

– ক্ষতিকারক অভ্যাস বা আচরণ পরিবর্তনের জন্য আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করুন এবং এই পরিবর্তনগুলি বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিন।

– আল্লাহর দয়ার প্রতি আশা রাখুন, জেনে যে একজন মানুষ যতবারই ব্যর্থ হোক না কেন, আল্লাহর ক্ষমার দরজা সবসময় খোলা।

৫. দান (যাকাত এবং সাদাকা): উদারতার মাধ্যমে আত্মার শুদ্ধি 

দান করা কেবল কম ভাগ্যবানদের সহায়তা করার একটি উপায় নয়, এটি আত্মশুদ্ধিরও একটি শক্তিশালী উপকরণ। যাকাত, যা বাধ্যতামূলক দান, এবং সাদাকা, যা ঐচ্ছিক দান, উভয়ই আত্মাকে লোভ এবং পার্থিব সম্পদের আসক্তি থেকে পরিশুদ্ধ করতে কাজ করে। তাদের সম্পদের একটি অংশ দান করার মাধ্যমে, বিশ্বাসীরা দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে এবং নিজেদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে পার্থিব সম্পদ ক্ষণস্থায়ী।

আল্লাহ দানকারীদের জন্য বিশাল পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেনঃ

مَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَهُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ كَمَثَلِ حَبَّۃٍ اَنۡۢبَتَتۡ سَبۡعَ سَنَابِلَ فِیۡ كُلِّ سُنۡۢبُلَۃٍ مِّائَۃُ حَبَّۃٍ ؕ وَ اللّٰهُ یُضٰعِفُ لِمَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ ﴿۲۶۱﴾

“যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে তাদের দৃষ্টান্ত একটি শস্যদানার মতো, যা সাতটি শীষ গজায়; প্রতিটি শীষে রয়েছে একশটি শস্য। প্রতিটি শীষে থাকে একশত শস্য-দানা। আর আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ মহাদানশীল, মহাজ্ঞানী।”

(সূরা আল-বাকারাহ, ২:২৬১)

দান সহানুভূতি, উদারতা এবং বিনয় বাড়ায়, পাশাপাশি এটি ইবাদতের একটি কাজ হিসেবে কাজ করে যা বিশ্বাসীকে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যায়। এটি নফসের স্বার্থপর প্রভাব প্রতিহত করতে সাহায্য করে এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়ায়।

– প্রায়োগিক প্রয়োগঃ

– নিয়মিতভাবে আপনার আয়ের একটি অংশ দানের জন্য বরাদ্দ করুন, তা যাকাত বা ঐচ্ছিক সাদাকার মাধ্যমে হোক।

– শুধু অর্থ নয়, বরং সময়, দক্ষতা বা সহানুভূতি দিয়ে যারা প্রয়োজন তাদের সাহায্য করার সুযোগ খুঁজুন।

– আপনি যে আশীর্বাদগুলো পেয়েছেন তার উপর চিন্তা করুন এবং কিভাবে সেগুলো অন্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়া আপনার হৃদয়কে শুদ্ধ করতে সাহায্য করতে পারে।

৬. জ্ঞান অন্বেষণ (ইলম): নফসের পথ আলোকিত করা 

ইসলামে, জ্ঞান অন্বেষণ কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক একটি চর্চা নয় বরং আধ্যাত্মিকও। কুরআন, হাদিস এবং ইসলামিক শিক্ষার জ্ঞান জীবন যাপনের সঠিক পথ নির্দেশ করে এবং নফসের চাহিদা দমন করতে সহায়ক হয়। *ইলম* (জ্ঞান) অর্জন করা বিশ্বাসীকে সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে সাহায্য করে, যা তাকে প্রলোভন প্রতিরোধ করতে এবং ন্যায়বিচারের পথে অবিচল থাকতে সহজ করে তোলে।

নবী মুহাম্মাদ (সা) বলেছেনঃ

“জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর বাধ্যতামূলক।”

(সুনান ইবন মাজাহ)

ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন কেবল ব্যক্তিকে ক্ষমতায়িত করে না, এটি নফসের বিভ্রান্তিকর প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি ঢাল হিসেবেও কাজ করে। ইসলামের শিক্ষা বোঝার মাধ্যমে, একজন বিশ্বাসী আল্লাহর আদেশ প্রতিফলিত করে এমন তথ্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে এবং পাপে পড়া এড়াতে সক্ষম হয়।

– প্রায়োগিক প্রয়োগঃ

– নিয়মিতভাবে কুরআন, হাদিস এবং অন্যান্য ইসলামি জ্ঞান অধ্যয়নের জন্য সময় বরাদ্দ করুন।

– ইসলামিক শিক্ষা গভীরভাবে বোঝার জন্য স্টাডি সার্কেল, বক্তৃতা বা অনলাইন কোর্সে যোগ দিন।

– অর্জিত জ্ঞানকে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করুন, এটি নফসের চাহিদা নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে এবং চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করুন।

অধ্যায় ৭-এর উপসংহার 

ইসলামি আধ্যাত্মিকতায় আত্মশুদ্ধির উপকরণ—সালাত, রোজা, জিকর, তওবা, দান এবং জ্ঞান অর্জন—জিহাদ আল-নফস-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ইবাদত এবং আত্ম-পর্যালোচনার কাজগুলো আত্মাকে শৃঙ্খলিত করতে, পার্থিব চাহিদা দমন করতে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে। এই কার্যকলাপগুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে, একজন মুসলিম ধীরে ধীরে নফসকে দমন করতে পারে, ন্যায়ের পথে জীবনযাপন করতে পারে এবং আধ্যাত্মিক সফলতা অর্জন করতে পারে।

(চলবে-)

মোঃ শফিকুল ইসলাম প্রিয়

এই প্রকাশনাটির সর্বস্বত্ত লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত। এই প্রকাশনার আংশিক বা সম্পুণাংশ অন্য যেকোন মিডিয়াতে লেখকের নামে ছাড়া অন্য কারও নামে প্রকাশ করা কপিরাইট আইন এ দন্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গন্য হবে।...

মন্তব্য করুন

error: কন্টেন্ট কপি এবং পেস্ট protected!!